মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার। চায়ের রাজধানীখ্যাত এ জেলায় চা-বাগান রয়েছে ৯২ টি। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। চায়ের জন্য প্রয়োজন সুনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত। খরা বা বৃষ্টিহীনতা এবং অপরদিকে অতিবৃষ্টি দুটোই চায়ের জন্য মারাত্মক হুমকি। আর সাম্প্রতিক সময়ে সবুজ পাতার নরম শরীর ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি এখন আর মাটি শুষে নিতে পারছে না। অতিবৃষ্টিতে বিনষ্ট করে ফেলেছে চায়ের সুদিন। এর ফলে কমে যায় চায়ের গড় উৎপাদন। চা-বাগানগুলো তখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ পিছিয়ে থাকে। তাই দেশের অন্যতম অর্থকরী ও সম্ভাবনাময় চা-শিল্প আজ অতিক্রম করছে ক্রান্তিকাল।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ২২৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় অত্যন্ত বেশি। চা-বিশেষজ্ঞরা অতিমাত্রার এই বৃষ্টিপাতাকে ‘অমঙ্গল-সূচক’ হিসেবে দেখছেন। এর ফলে ব্যাহত হয়েছে চায়ের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা।
মাইজদিহি চা-বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, চা-গাছের মাটির উপরের স্তরকে ‘সাব-সয়েল’ বলে। এই সাব-সয়েলগুলো চা-গাছের জন্য খুব উর্বর। অধিক বৃষ্টির ফলে চা-গাছের মাটির উপরের সাব-সয়েলগুলো দ্রুত ‘ওয়াস আউট’ হয়ে যায়। এই ওয়াস আউটের ফলে মাটির গুণাবলি নষ্ট হয়ে কার্যকারিতা হারায়। এর ফলে চা-গাছগুলো মাটি থেকে ভালো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। ব্যাহত হয় উৎপাদন। বৃষ্টিপাত বেশি হলে ‘ডে-টেম্পারেচার’ স্বাভাবিক থাকে না। এই দৈনিক তাপমাত্রা নিচে চলে যাবার ফলে চা-গাছে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটে। এর ফলে চা-গাছ নতুন কুঁড়ি ছাড়তে দেরি করে।
সিলেট বিভাগের প্রবীন ‘টি-প্লান্টার’ ও চা-গবেষক শাহজাহান আখন্দ বলেন, চা-গাছগুলো ‘রেগুলার’ পর্যাপ্ত ‘সানলাইট’ পাচ্ছে না। ‘মিনিমাম’ ১১ ঘন্টা ‘সানলাইট’ পাওয়ার কথা। তা না পেলে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যাহত হবে। এ সবই চা-শিল্পের জন্য মারাত্মক ‘অ্যালার্মিং’। যদি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে তবে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এটি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। টিলার একদিকে চা-পাতা হবে না। কারণ সেপ্টেম্বরের পর থেকে মাটির ‘টেম্পারেচার’ কমে যাবে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে গেলে চা-গাছ আর খাদ্যগ্রহণ করতে পারে না।
শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সিনিয়র অবজারভার মো. হারুনুর রশিদ বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৬ মাসে মোট ২২৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত। বিগত বছরগুলোতে এতো বৃষ্টিপাত কখনো হয়নি। ২০১৬ সালের ওই তারিখে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৪১৮ মিলিমিটার, ২০১৫ সালের ওই তারিখে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৫৯৩ মিলিমিটার এবং ২০১৪ সালের ওই তারিখে ১০৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ হারুনুর রশিদ। এছাড়া তিনি আরো বলেন, বর্তমানে নিম্নচাপের কারণে এই অবস্থা। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে দেশে সর্বোচ্চ ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা চা-শিল্পের ১৬২ বছরের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তবে এই অতি বৃষ্টিরধারা অব্যাহত থাকায় বর্তমানে চা উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমে গেছে।
উল্লেখ্য, দেশের মোট ১৬৩টি ছোট বড় চা-বাগান রয়েছে। সিলেট বিভাগে রয়েছে ১৩৪ টি চা-বাগান। এর মধ্যে শুধু মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, জুড়ি উপজেলায় রয়েছে ৯২টি চা-বাগান। এছাড়াও সিলেটের হবিগঞ্জে ২২টি, সিলেট সদরে ২০টি বাগান রয়েছে। চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রাজশাহী বিভাগে রয়েছে ৫টি চা-বাগান। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছেন প্রায় ১০-১২ লাখ মানুষ।