অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে : দেবী মনসার প্রতি হাজারো ভক্তের বিনয়াবনত: শ্রদ্ধা জানিয়ে, শঙ্খ-উলুধ্বনি দিয়ে, মঙ্গল প্রদীপ আর ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বরিশালের আগৈলঝাড়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে মধ্যযুগের মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচয়িতা, বাংলা সাহিত্যের অমর কবি বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরের ৫২২ বছরের পুরোনো বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূজা উপলক্ষে ইতোমধ্যে সাধু-সন্যাসী, দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত এবং স্থানীয় বিভিন্ন উপজেলার হাজারো নারী-পুরুষ পূজারী ও ভক্তদের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠেছিল মন্দির আঙ্গিনা। মন্দিরের পার্শ¦বর্তী এলাকায় পূজা উপলক্ষে বসেছে গ্রামীণ মেলা। বাৎসরিক এই পূজা উপলক্ষে মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থকে উপজীব্য করে তিনদিন ব্যাপী রয়ানী পালাগান শেষ হয়েছে গত ১৪ আগস্ট। মনসা মঙ্গল কাব্যে বর্ণিত কাহিনী চয়ন করে রয়ানী শিল্পীরা নৃত্যগীতের মধ্যদিয়ে মনসা মঙ্গল কাব্যের রস ফুটিয়ে তোলেন তাদের গানে। যুগ যুগান্তর থেকে রয়ানি গানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ মনসার পূজার মাধ্যমে সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টায় পূজা করে আসছে। বাৎসরিক পূজা শেষে সকালে পূজা অর্চনা শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে চলে ভোগরাগ, বলিদান ও ভোগের প্রসাদ বিতরণ।
প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে ইংরেজী ১৪৫০ সালে বিজয় গুপ্ত জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম সনাতন গুপ্ত ও মায়ের নাম রুক্কিনী দেবী। বিজয় গুপ্ত ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিষহরি দেবী মনসা কর্তৃক স্বপ্নে আদিস্ট হয়ে ফুল্লশ্রী গ্রামের মনসাকুন্ড নামে খ্যাত বর্তমান মন্দিরের পার্শ্ববর্তী দীঘি থেকে স্বপ্নে প্রাপ্ত ঘট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর কবি বিজয় গুপ্ত দেবী পদ্মা বা দেবী মনসা কর্তৃক পুনরায় স্বপ্নে আদিস্ট হয়ে দীঘির পার্শ্ববর্তী বকুল গাছের নীচে বসে নবাব হোসেন শাহ’র শাসনামলে (১৪৯৪ সালে) পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের অমর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করায় কবি বিজয় গুপ্ত সুলতানের দরবারে ‘মহাকবি’ উপাধি লাভ করেন। বিজয় গুপ্ত বিভিন্ন এলাকায় কিছুকাল সদলবলে মনসা মঙ্গল গানও করেন। এরপর তিনি তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কাশীধাম গমণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকসেনারা বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরের অভ্যন্তরে ব্যাপক লুটতরাজ ও ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। লুটতরাজ শেষে শুধুমাত্র রেখে যায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত ঘটটি। স্বাধীনতার পর থেকে ওই ঘটেই চলে আসছিল নিত্যদিনের পূজা অর্চনা। দেবী মনসার মন্দিরের বাৎসরিক পূজা উপলক্ষে সকাল ৭টায়, দুপুর ১টায় ও বিকেল ৪টায় তিন দফায় পূজা অর্চনা, ভোগরাগ, ছাগ বলিদান ও ভোগের প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের বিভিন্ন মন্দিরে ও বাড়িতে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।