‘ও বউ ধান ভানে রে, ঢেঁকিতে পার দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে, হেলিয়া দুলিয়া…।’ ঢেঁকি পাড়ে পল্লী বধূদের এমন গানে মুখরিত হতো বাংলার গ্রামীণ জনপদ। ধান থেকে চাল, সেটা থেকে তৈরি আটা। এ দু-ই প্রস্তুতের একটি মাধ্যম ঢেঁকি। নবান্ন এলেই ঢেঁকি পাড়ে ধুম পড়তো নতুন ধানে আটা তৈরির। গ্রামে এখন আর আগের মত চোখেই পড়ে না। হয়তো এমন একদিন আসবে যখন ঢেঁকি দেখার জন্য জাদুঘরে যেতে হবে।
সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আর্বিভাব ঘটেছিল। আবার গতিময় সভ্যতার যাত্রাপথে প্রযুক্তিগত উতকর্ষেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ‘ঢেঁকি শব্দটি’ প্রবীনদের কাছে শোনা শুধুই অতিতের গল্প মাত্র। বাস্তবে ঢেঁকি নেই। নেই এর ব্যবহার। আশির দশক থেকে ক্রমান্নয়ে ঢেঁকি বিলুপ্তির পথে। তাই ঢেঁকির বিকল্প হিসাবে গাঁয়ের বধূরা ব্যবহার করছেন লোহার তৈরি বিশেষ যন্ত্র ‘হ্যামানদস্তা’।
এর আগে এসব ঢেঁকিতে তৈরি করা আটা দিয়ে ঘরে ঘরে প্রস্তুত করা হতো পুলি, ভাপা, পাটি শাপটা, তেলপিঠা, চিতইসহ নানান ধরনের বাহারি সব পিঠা-পুলি। পিঠার গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। উৎসবমুখর পরিবেশে উৎযাপন করা হতো নবান্ন উৎসব। গ্রামীণ জনপদগুলোতে এখন বিড়াজ করছে শহুরে আমেজ। তাই গ্রামে আর নেই সেই ঢেঁকি, নেই পল্লী বধূদের মনমাতানো গান। কিছু জায়গায় নবান্ন উৎসব হলেও পিঠা-পুলির তেমন সমাহার আর চোখে পড়েনা। গ্রাম বাংলার এমন চিরায়ত সব ঐতিহ্য এখন শুধুই স্মৃতি।
ঢেঁকিছাটা চাল শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হওয়ায় তা দিয়ে গ্রামের শিশুদের জাউ তৈরি করে খায়ানো হতো। কিন্তু কাল চক্রের বিবর্তন ও যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে ধান থেকে চাল-আটা তৈরীর একমাত্র মাধ্যম গ্রামীন ঢেঁকি।
গ্রামীন ঢেঁকির বিবরন,- ঢেঁকি বড় কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরী। অন্তত ৬ ফিট লম্বা। যার অগ্রভাগের মাথার কাছাকাছি দেড় ফিট লম্বা মনাই। মনাইয়ের মাথায় পড়ানো লোহার রিং (আঞ্চলিক ভাষায় চুরন বলা হয়)। চুরন বার বার যেখানে আঘাত করে নিচের সেই অংশটুকুর নাম গর। সেটিও কাঠের তৈরী। ঢেঁকিতে ধান বা চাল মাড়াই করতে কমপক্ষে তিনজন মানুষের প্রয়োজন হয়। পেছনের লেজ বিশিষ্ট চ্যাপ্টা অংশে এক বা দু’জন পা দিয়ে তালে তালে চাপ দিলে মনাই সজোরে গরের ভেতর ধান বা চালের ওপর আঘাত করে। তবে মনাই ওঠা নামার ছান্দিক তালে তালে আরো একজন মহিলা আঁকারা ধান চাল মাড়াই করতে সাহায্যে করে। তবে ঢেঁকিতে পাড় দেয়া আর আল্যি দেয়ার মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে ছন্দপতন ঘটতে পারে।
বর্তমান সময়ে কিছু কিছু বাড়িতে ঢেঁকি থাকলেও তা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজি চাল থেকে আটা প্রস্তুত করতে নেওয়া হয় ২০-২৫ টাকা। ঢেঁকির মালিক নিজের লোকবল দিয়েই ওই আটা প্রস্তুত করেন। আধুনিক মেশিনে প্রস্তুত করা আটার তৈরি পিঠাতে স্বাদ না থাকা এবং ভাল পিঠা না হওয়ায় কিছু মানুষ টাকা দিয়েই ঢেঁকিতে আটা তৈরি করতে আসে।
রমেলা বেগম (৫০) বলেন, তাদের বাড়িতে ঢেঁকিতে আটা প্রস্তুত করা হতো। সেই আটায় তৈরি হতো বাহারি সব পিঠা। পিঠার স্বাদ মুখে লেগে থাকতো। এখন আর ঢেঁকি নেই,নেই সেই স্বাদের পিঠাও। মেশিনে ভাঙ্গানো আটায় পিঠা ভালো হয়না। তাই এখন বাধ্য হয়ে বাড়িতে বসে ‘হ্যামানদস্তা’ দিয়ে চাল গুড়ো করে আটা বানানো হচ্ছে।