আদালতে মা যখন পরকিয়া প্রেমিকের সঙ্গে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব তখন সন্তানদ্বয় মায়ের হাত ধরে শত শত মানুষের সামনে কাঁদতে শুরু করে। শিশুদের কান্নায় স্বজনরা যেমন কাঁদলো তেমন আদালতে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ফেললো।
মেয়েটির বয়স ১৩ কি ১৪। ছেলেটির বয়স প্রায় ১০ বছর। মায়াভরা কচি দুটি মুখ। চিৎকার করে কাঁদছে তারা মাকে জড়িয়ে ধরে। তারা কিছুতেই মাকে ছাড়বে না। হাউমাউ করে কাঁদছে বাচ্চা দুটি আর বলছে, ‘মা, ওমা! তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকতে পারমু না। মা, ও…মা…তুমি যেও না।’
তাদের এমন চিৎকারে নারায়ণগঞ্জ আদালতের জিআরওতে ভিড় জমে যায়। ছুটে আসেন আইনজীবি, সাংবাদিক, বিচারপ্রার্থীসহ আশপাশে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও। সবাই এসে থমকে দাঁড়ায়। এমন করুণ ও হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সিনেমাতেও বিরল।
মাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা দুটি আরও জোরে কাঁদতে থাকে। পাশে দাঁড়ানো ছিলো তাদের বাবা ইউসুফ মিয়াও। তিনিও কাঁদছিলেন মাথায় হাত দিয়ে। বাচ্চা দুটি একটু আগেই জেনে গেছে তাদের মা তাদের ছেড়ে অন্য একজন লোকের সঙ্গে চলে যাবে। আর ফিরবে না।
একটু আগে আদালতে তাদের মাকে পুলিশ হাজির করলে তাদের মা স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তিনি সজিবকে বিয়ে করেছেন। তাকে অপহরণ করা হয়নি। তিনি সজিবের সাথেই থাকতে চান।’ তখন বাচ্চা দুটি আদালতেই উপস্থিত ছিল।
রবিবার দুপুরে সস্তাপুর থেকে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ কথিত অপহরণের শিকার সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের মেয়ে নাজিরা আক্তার মিতুকে উদ্ধার করে। এরপর তাঁকে গতকাল দুপুরে হাজির করা হয় নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্তের আদালতে। এখানে তিনি ২২ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করেন। আদালতকে মিতু জানায় সে তার আগের স্বামী ইউসুফ মিয়া নয় বর্তমান স্বামী আবুল হোসেন সজিবের সাথে থাকতে চায়। সে তার আগের স্বামীকে তালাক দিয়েছে এবং বর্তমানে সজিবকে বিয়ে করেছে। মিতু এসব তথ্যও উপস্থাপন করে।
মিতু স্বাভাবিক ও সাবালক হওয়ার কারণে এবং আইনগতভাবে তাকে বাধ্য করার কোনো উপায় না থাকায় তার ইচ্ছের বিরোধীতা করেনি আদালত। ফলে মিতুকে তার নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে আদালত থেকে মিতু সাড়ে তিনটার দিকে বের হয়ে জিআরওর কাছে এলেই তাকে ঘিরে ধরে তার ১৩ বছরের বড় মেয়ে এবং ১০ বছরের ছেলে। তারা কিছুতেই যেতে দেবে না তাদের মাকে। তারা যে মাকে ছাড়া থাকতে পারবে না চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে কথাই বলছিলো সবাইকে। সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল যেন সবাই বোঝায় তাদের মাকে।
এমন দৃশ্যে উপস্থিত আইনজীবি, পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিচারপ্রার্থীদের চোখও ছলছল করছিলো। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্যে চোখ মুছছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ মিতুকে নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে টানাটানি শুরু হয়। একদিকে পরকীয়া প্রেমিকের পরিবার অন্যদিকে তাঁর দুই সন্তানসহ মায়ের বাড়ির লোকজন তাকে টানতে থাকে নিজেদের দিকে। মিতুও সন্তানদের কান্না, মায়া উপেক্ষা করে পা বাড়াচ্ছিল পরকীয়া প্রেমিকের পরিবারের দিকে।
সন্তানদের কান্নায় পুরো আদালত চত্বরের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে উপস্থিত আইনজীবিরা। তারা টানাটানি না করে মিতুর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে বলে।
মিতুর দুই সন্তানের কান্নায় পুরো আদালতের মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। কারো মুখেই কোনো ‘রা’ নেই। সবাই হতবাক। কেউ কেউ বলে উঠছিলেন, ‘এ কেমন মা’! আবার কেউ বলছেন, ‘হায় রে পরকীয়া…!’ এক পর্যায়ে আদালতের বাইরে অপেক্ষামান কালো একটি নোয়াহ মাইক্রোবাসে মিতুর বাবার লোকজন মিতুকে একরকম জোর করে দুই সন্তানসহ উঠিয়ে নিয়ে যায়।
নাজিরা আক্তার মিতু ভূইগড় এলাকার রূপায়ন টাউনের ইউসুফ মিয়ার স্ত্রী ও দুই সন্তানের জননী এবং সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা নাজিম উদ্দিনের পালিত মেয়ে। ১৮ এপ্রিল সে তার পরকীয়া প্রেমিক গোদনাইল এলাকার চোরাই তেল ব্যবসায়ী ও এক সন্তানের জনক আবুল হোসেন সজিবের সঙ্গে পালিয়ে যায়।
১৮ এপ্রিল ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় ২৬ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করে মিতুর স্বামী ইউসুফ মিয়া। মামলায় অভিযুক্ত করা হয় পরকীয়া প্রেমিক আবুল হোসেন সজিব, মুনসুর, জিবন, লিমন ও নাজমুলকে। এ ছাড়াও এ ঘটনার পর মিতু ও সজিবের পরিবারের পক্ষ থেকে ফতুল্লা মেডল থানায় দুটি পাল্টাপাল্টি ডায়েরি করা হয়েছিলো। এরমধ্যে ২০ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় ইউসুফ মিয়া সাধারণ ডায়েরি করে। এখানে সজিবের সাথে মালামাল নিয়ে মিতু পালিয়েছে বলে দাবি করা হয়।
অপরদিকে সজিবের পরিবার থেকে ২৮ এপ্রিল অপহরণের অভিযোগ এনে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয় একই থানায়। সেখানে সজিবের বড় ভাই দাবি করেন, ২৫ লাখ ১২ হাজার টাকাসহ নাজিরা আক্তার মিতু তার ভাই মিঠু ও শিপু এবং বাবুলের ছেলে কায়েছ তার ভাই সজিবকে একটি প্রাইভেটযোগে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর আর তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগে ২৬ এপ্রিল নাজিরা আক্তার মিতুকে অপহরণ করা হয়েছে দাবি করে ফতুল্লা মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনী ২০০৩এর ৭/৩০ধারায় দায়ের করে তার স্বামী ইউসুফ মিয়া। মামলা নং ১০১। এ ঘটনায় আবুল হোসেন সজিবের ভাই বড় ভাই নিজামকে জালকুড়ি এলাকা থেকে আটক করে নিয়ে যায়। বর্তমানে সে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে।
সূত্র জানায়, মিতুর সাথে সজিবের পরকীয়ার ঘটনা সজিবের স্ত্রী সায়মা আক্তার জানতে পেরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর গত বছরের ২৩ আগষ্ট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এদিকে সজিবের স্ত্রীর লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মতিয়ার রহমান উভয় পক্ষকে ডেকে শাসিয়ে দেন এবং ‘কেউ কারো সাথে সম্পর্ক রাখবে না’ সজিবের কাছ থেকে এমন লিখিতও গ্রহণ করেন বলে সজিবের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।
এরপরও নাজিরা আক্তার মিতু ও আবুল হোসেন সজিবের মধ্যকার পরকীয়া চলতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দুই সন্তান ও স্বামী রেখে নাজিরা আক্তার মিতু পালিয়ে যায়। এতে সজিবকে সন্দেহ করে ২৯ এপ্রিল ফতুল্লা থানায় ডায়ের করে মিতুর স্বামী ইউসুফ মিয়া। ডায়েরি নং ১১১৬।
নাজিরা আক্তার মিতুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আবুল হোসেন সজিব আমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসেনি। আমি নিজ ইচ্ছায় সজিবের সাথে চলে এসেছি। আমি নিজে গাড়ী নিয়ে সজিবের বাসার সামনে থেকে সজিবকে নিয়ে এসেছি। সজিবের সাথে আমার ৩ বছর যাবৎ প্রেমের সম্পর্ক এবং গত দু’মাস আগে আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। এখন আমরা ঘর সংসার করছি।
Related